একটাই পৃথিবী: প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন
আজ ৫ জুন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশ জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে। এ বছর পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘একটাই পৃথিবী: প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন’, যার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের আবেদন জানানো হয়েছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীতে খুব দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, যার ফলে মানুষ এবং প্রকৃতির জন্য খাপ খাইয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী বন ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশদূষণের কারণে মাটি, পানি ও বায়ু বিষাক্ত হয়ে উঠছে। পৃথিবীকে এই প্রতিকূল অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণবাদী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, আমলা, গবেষক, সাংবাদিক ও বিজ্ঞানীরা নিরলস কাজ করে চলেছেন। অধিকন্তু বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপন। এটি ১৯৭২ সালে প্রথম জাতিসংঘ সম্মেলন থেকে শুরু হয়েছিল, যা সাধারণত স্টকহোম সম্মেলন নামে পরিচিত। অতঃপর ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এ বছর দিবসটির উদ্যাপন একটি স্বাভাবিক পৃথিবী এবং জলবায়ু-সহনশীল উন্নয়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন, বন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, প্লাস্টিক বর্জ্য, দূষণ এবং বাস্তুতন্ত্র বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় শিকার। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের চ্যালেঞ্জ থেকে পরিবেশকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে একটি উদ্যোগ হলো, বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮(ক) ধারা অন্তর্ভুক্ত করা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।’ এই ধারা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ এবং বিভিন্ন সেক্টরে পরিকল্পনা, আইন-কানুন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২০২১, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩, জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬, জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা ২০১৬-২০২১, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, রক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৭।
এ ছাড়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫) সবুজায়ন বৃদ্ধি এবং পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার করা হয়েছে। একইভাবে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১-এ পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রশংসার দাবি রাখে। যেখানে ২০৪১ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ ১৪ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসব উদ্যোগের ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বন বিভাগ বননির্ভর সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে বন্য প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ২২টি রক্ষিত বনাঞ্চলে সহব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করণার্থে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বন অধিদপ্তর বনায়ন কার্যক্রমে দেশীয় প্রজাতি রোপণে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবেশ অধিদপ্তর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুবিধার জন্য টেকসই পরিবেশগত সুশাসন এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশগত নিয়ম ও প্রবিধান প্রণয়ন করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর দিকনির্দেশিকা, প্রশিক্ষণ এবং পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতার মাধ্যমে জটিল পরিবেশগত সমস্যাগুলোর ওপর টেকসই পদক্ষেপ নিতে জনসাধারণের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে। রুটিন কর্মসূচির পাশাপাশি বর্তমান সরকার কার্বন নিঃসরণ রোধ, বন উজাড় ও বনভূমি হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব শক্তি ও প্রযুক্তি উৎসাহিত করার জন্য অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বে কাজ করছে। পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য অংশীজনদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও এবং নাগরিক সমাজ, যারা পরিবেশের উন্নতির জন্য কাজ করছে। উন্নয়ন অংশীদারেরা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশগত এবং সামাজিক সুরক্ষাসহ পরিবেশগত বিষয়ে সরকারকে কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও দক্ষ জনবলের অভাব, পরিবেশের প্রতি মানুষের অসচেতনতা, নিয়ম ও নীতির সমন্বয়হীন প্রয়োগ এবং আইন প্রয়োগে অনীহা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর বর্তমান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং প্রশমনের ক্ষেত্রে বিবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
পরিবেশ ও প্রতিবেশের এ অবস্থা উন্নয়নে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্তকরণের কোনো বিকল্প নেই। জনসচেতনতা কর্মসূচিগুলোয় অধিক সবুজায়ন, স্বল্প কার্বন ফুটপ্রিন্টের জীবনধারা, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কম পরিবেশদূষণ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের কম ব্যবহার উৎসাহিত করার ওপর জোর দেওয়া উচিত। সর্বোপরি ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ, অভিজাত-সাধারণ, ধর্মীয়- রাজনৈতিক নেতাসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণের পরিবেশগত স্থায়িত্বশীলতার জন্য একসঙ্গে কাজ করার এবং বাংলাদেশের বর্তমান এই অর্থনৈতিক রূপান্তরকে অর্থবহ করার এখনই সময়।
লেখক:
মো. সামছ উদ্দিন: একাডেমিক এন্ড রিসার্স কো-অর্ডিনেশন বিশেষজ্ঞ; কম্পাস প্রোগ্রাম; ইউএস ফরেষ্ট সার্ভিস; বাংলাদেশ। সহদেব চন্দ্র মজুমদার: জিআইএস এনালিস্ট; কম্পাস প্রোগ্রাম; ইউএস ফরেষ্ট সার্ভিস; বাংলাদেশ।
Source : Desh Rupantor